কাজা নামাজ আদায় করতেই হবে

অনেক আমল আছেযা সময় পার হয়ে গেলে করতে হয় না বা করার সুযোগ থাকে নাকিন্তু নামাজ এমন একটি বিধান যা পালন করতেই হবে। সাম্প্রতিক আমাদের কিছু ভাই কাজা নামাজ নামে কিছু নেই বলে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাদের দাবিনামাজ কাজা হয়ে গেলে তা পড়তে হয় না। তওবা করে নিলেই তা মাফ হয়ে যায়। হাক্কানি ওলামায়ে কেরাম কোরআন-হাদিসের আলোকে বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

) পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'নিঃসন্দেহে মোমিনদের প্রতি নামাজ অপরিহার্য রয়েছেযার সময়সীমা নির্ধারিত।এ আয়াতে নামাজের সময়সীমা নির্ধারিত হওয়ার বিষয়টি যেমন উল্লেখ করা হয়েছেতেমনি নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা না হলে পরবর্তী সময়ে ওই নামাজ কাজা করার বিষয়টিও পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এটা আল্লাহ তায়ালার ঋণআর ঋণ সময়মতো আদায় না করতে পারলে পরবর্তী সময়ে তা আদায় করা জরুরি।

যেমন নিচের হাদিসে ওপরের আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে-
) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনএক মহিলা নবীজি (সাঃ) এর কাছে এসে বললেনআমার মা মান্নত করেছিলেন যেতিনি হজ করবেন। কিন্তু তা আদায় করার আগেই তিনি মারা যান। এখন আমার করণীয় কীনবীজি (সাঃ) এরশাদ করেনতুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ করে নাও। বলো তোযদি তোমার মা কারও কাছে ঋণী হতেন তুমি কি তার ঋণ পরিশোধ করতেমহিলা বললেনহ্যাঁতখন তার জবাবে নবীজি (সাঃ) এরশাদ করেনতবে তোমরা আল্লাহর ঋণকেও পরিশোধ করো। কেননাতিনি তাঁর প্রাপ্য পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। (বোখারিঃ ১/২৪৯নাসায়িঃ ২/২)

এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা গেলযে ইবাদত বান্দার ওপর ফরজ বা অবশ্য কর্তব্যতা বান্দার ওপর আল্লাহ তায়ালার পাওনা বা ঋণ। এ ঋণ থেকে দায়মুক্তির পথ হলো তা আদায় করা। যেমনিভাবে মানুষের পাওনা ঋণের নির্ধারিত সময় পার হওয়ার দ্বারা মানুষের ঋণ থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় নাতেমনি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার ঋণ থেকেও দায়মুক্ত হওয়া যায় না। আর শরিয়তে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজের ব্যাপারে এ মূলনীতি যে পুরোপুরি প্রযোজ্য হবেজ্ঞানীমাত্রই তা বুঝতে সক্ষম।

অন্য একটি হাদিসে রাসূল (সাঃ) কর্তৃক কাজা নামাজ আদায় করার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন-
) এক রাতে নবীজি (সাঃ) তাঁর সাহাবিদের নিয়ে সফর করছিলেন। শেষ রাতে বিশ্রামের উদ্দেশে সফর বিরতি দিলেন। হজরত বেলাল (রাঃ) কে ফজরের নামাজের জন্য জাগিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দিলেন। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে হজরত বেলাল (রাঃ) ও তন্দ্রাবিভূত হয়ে পড়লেন। ফলে সবার ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেল। নবীজি (সাঃ) ঘুম থেকে জেগে সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পর সবাইকে নিয়ে ফজরের নামাজ কাজা করলেন। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছেঘুম বা বিস্মৃতির কারণে যার নামাজ ছুটে গেলযখন সে জাগ্রত হবেতখন সে যেন তা আদায় করে নেয়। (বোখারিঃ ৫৯৭মুসলিমঃ ৬৮১)

উপরের হাদিসে লক্ষণীয় বিষয় হলোনবীজি (সাঃ) ওয়াক্ত পার হয়ে যাওয়া ফজর নামাজকে কাজা হিসেবে আদায় করে নিলেন এবং কাজা হয়ে যাওয়া নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিলেন। তিনি এ কথা বললেন না যেনামাজের ওয়াক্ত শেষ হয়ে গেছেতোমরা তওবা করে নাও। প্রমাণিত হলোকাজা নামাজ আদায় করতে হবে। এ হাদিসের ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনসেই দুই রাকাত যা নবীজি (সাঃ) কাজা হিসেবে আদায় করেছেনআমার কাছে তা গোটা দুনিয়ার মালিকানা লাভ করার চেয়েও অধিক পছন্দনীয়। (মুসনাদে আহমাদঃ ৪/১৮১মুসনাদে আবি ইয়ালাঃ ৩/২২-২৩২৩৭১)

নিচের হাদিসে বিষয়টি আরও স্পষ্টাকারে উল্লিখিত হয়েছে-
) খন্দকের যুদ্ধ থেকে ফেরার দিন নবীজি (সাঃ) তাঁর সাহাবিদের বনু কোরায়জা অভিমুখে পাঠানোর সময় বললেনতোমাদের কেউ যেন বনু কোরায়জায় না পৌঁছে আসরের নামাজ না পড়ে। সাহাবায়ে কেরাম রওনা হলেন। পথে আসরের নামাজের সময় অতিবাহিত হওয়ার উপক্রম হলে কিছু সাহাবি পথেই সময়ের ভেতর আসর পড়ে নেন। আর কিছু সাহাবি বনু কোরায়জায় পৌঁছার পর আসরের নামাজ কাজা পড়েন। নবীজি (সাঃ) এ ঘটনা শুনলেন। (বোখারিঃ ১/১২৯৪১১৯মুসলিমঃ ২/৯৬)

কিন্তু পরে কাজা আদায়কারীদের এ কথা বলেননি যেনামাজ শুধু নির্ধারিত সময়েই আদায়যোগ্য। সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এর কোনো কাজা নেই। সুতরাং এ হাদিস থেকে পরিষ্কার বোঝা গেলকোনো কারণে নামাজ ওয়াক্তমতো না পড়তে পারলে সেই নামাজ অবশ্যই কাজা পড়তে হবে। এ কারণে যারা কাজা পড়েছিলেন নবীজি (সাঃ) তাদের সমর্থন করেছিলেন।

) স্বয়ং নবীজি (সাঃ) এর খন্দকের যুদ্ধের সময় কয়েক ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়ে গিয়েছিল। তথা যুদ্ধের কারণে সময়মতো পড়া সম্ভব হয়নি। এসব নামাজ তিনি কাজা হিসেবে পড়ে নিয়েছিলেন। (বোখারিঃ ১/১৬২২/৩০৭)

নতুন করে ভাবার সুযোগ নেইঃ
এ প্রসঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলো ইজমায়ে উম্মত। মুসলিম উম্মাহর সব মুজতাহিদ ইমাম এ ব্যাপারে একমতফরজ নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় করা না হলে সময়ের পর তা কাজা করতে হবে। এ ব্যাপারে ইচ্ছাকৃতভাবে কাজা করা বা কোনো ওজরে কাজা হয়ে যাওয়া উভয় ধরনের বিধানই সমান। যেমন মালেকি মাজহাবের সুপ্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে আবদুল বার (রহঃ) বিনা ওজরে অনাদায়কৃত নামাজ কাজা করা অপরিহার্য হওয়ার সপক্ষে শরয়ি প্রমাণাদি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 'ফরজ রোজার মতো ফরজ নামাজও সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কাজা করতে হয়। এ ব্যাপারে যদিও উম্মতের ইজমাই যথেষ্ট দলিল। যার অনুসরণ করা ওইসব বিচ্ছিন্ন মতের প্রবক্তাদের জন্যও অপরিহার্য ছিল। তারপরও কিছু দলিল উল্লেখ করা হলো যথা-

নবীজি (সাঃ) এর বাণী। (আল ইসতিজকারঃ ১/৩০২-৩০৩)। এছাড়া হাদিসের প্রত্যেক কিতাবে 'বাবু কাজাইল ফাওয়ায়েততথা ছুটে যাওয়া নামাজ কাজা করার অধ্যায় নামে কাজা নামাজ পড়ার পদ্ধতির ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। কাজা নামাজ আদায় করা জরুরি হওয়ার ব্যাপারে এটাও মজবুত প্রমাণ।

জেনে নিন কাজা নামাজ আদায় করার পদ্ধতিঃ
নামাজ একটি অবশ্য পালনীয় বিধান। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কসুস্থসবল বিবেকবান মুসলমান নর-নারীর ওপর প্রত্যহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ফরজ। ইচ্ছাকৃত নামাজ ছেড়ে দেয়া কবিরা গুনাহ। পরে তার কাজা আদায় করা ওয়াজিব। কেউ যদি তওবাও করে তাহলেও কাজা নামাজ আদায় করার হুকুম বিলুপ্ত হয় নাএমনকি হজ্জ্ব করার মাধ্যমেও মাফ হয় না। কেউ যদি কাজা নামাজ আদায় না করে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং এ রোগে মারা যায় আর অসুস্থাবস্থায় লোকটি ওয়ারিশদের তার পক্ষ থেকে কাজা নামাজের ফেদিয়া দেয়ার কথা বলে যায় এ অবস্থায় তার ওয়ারিশদের ওপর ফেদিয়া দেয়া ওয়াজিব। এমন অনেক লোক রয়েছেযাদের জিম্মায় অনেক কাজা নামাজ রয়েছে।

কাজা নামাজ আদায় করার সময় এ নিয়ত করতে হবেআমি অমুক দিনের জোহরের নামাজ কাজা আদায় করছি। যদি দিন-তারিখ মনে না থাকেএমতাবস্থায় এভাবে নিয়ত করবে আমি আমার জীবনের সর্বপ্রথম জোহর নামাজের কাজা আদায় করছি। এভাবে প্রত্যেক কাজা নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে নিয়ত করবে। এভাবে ততদিন পর্যন্ত কাজা নামাজ আদায় করতে থাকবেযতক্ষণ না ব্যক্তির মন এ সাক্ষ্য দেবেতার জিম্মায় কোনও নামাজ কাজা নেই। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলপ্রত্যেক নামাজের জামাতের কিছু সময় আগে মসজিদে চলে যাবেনযেন একাধিক ওয়াক্তের কাজা আদায় করতে পারা যায়। যেমন কোনও ব্যক্তি আসর নামাজের আজানের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদে গিয়ে আগের কাজা আসর নামাজ আদায় করল। এভাবে কাজা নামাজ আদায় করতে করতে একটা সময় আসবে যখন মনে হবে তার আর কোনও নামাজ কাজা নেই। যে ব্যক্তির জিম্মায় কাজা নামাজ রয়েছেতার জন্য উত্তম হল নফল নামাজের পরিবর্তে কাজা নামাজ আদায় করা। কেন না সে কাজা নামাজ সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।

তাহাজ্জুদএশরাক ও অন্যান্য নফল নামাজের সময় কাজা আদায় করবে। এজন্য যেআশা করা যায় এ সময় কাজা আদায় করার মাধ্যমে তাহাজ্জুদএশরাক ও অন্যান্য নফল নামাজেরও সওয়াব পাওয়া যাবে। (ফতওয়ায়ে মাহমুদিয়ার ১১তম খণ্ডের ৪৫৩নং পৃষ্ঠা)

শবেবরাতশবেকদরেও কাজা আদায় করবে। উল্লেখ্যকাজা নামাজ আদায় করার সময় শুধু ফরজ ওয়াজিব আদায় করবে। সুন্নত আদায় করতে হবে না। যেমন কোনও ব্যক্তির যদি এশার নামাজ কাজা হয়ে থাকেএমতাবস্থায় সে শুধু চার রাকাত ফরজ এবং তিন রাকাত বেতের নামাজ আদায় করবে। তবে কারও যদি ফজর নামাজ কাজা হয়ে যায় এবং তা দ্বিপ্রহরের আগে আদায় করার ইচ্ছা করেএমতাবস্থায় সুন্নতসহ ফরজ নামাজ আদায় করবে। আর কারও যদি জুমার নামাজ কাজা হয়ে যায় তাহলে জুমার কাজা আদায় করবে না বরং চার রাকাত জোহর নামাজ আদায় করবে।

৪টি মন্তব্য:

  1. ৫০ বছর বয়সে একজন ব্যক্তি নামাজ পড়তে শুরু করলো তার জন্য কোন কাজা নামাজ আছে কিনা? উমরি কাজা বলে কিছু আছে কিনা? কোরআন এর স্পষ্ট আয়াত এবং হািদস উল্লেখ পুর্বক ব্যাক্ষা দিন।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. উপরে উল্লিখিত তথ্য দেওয়ার পর ও দলীল চাইছেন? আর শরিয়ত এটা দেখবেনা যে কার কত বৎসর কাজা আছে? কাজা যখন আদায়ের প্রমাণ দেওয়া হল তখন যত বৎসর ই হোক আদায় করতে হবে

      মুছুন
  2. হাদিসের আরবি ইবারত দিলে ভালো হতো

    উত্তরমুছুন